ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যা কেবল মানুষের অধিকার নয়, বরং আল্লাহর সৃষ্ট সমস্ত জীবের অধিকার নিশ্চিত করার শিক্ষা দেয়। প্রাণীদের প্রতি সদয় আচরণ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। আল্লাহ তাআলা মানুষকে জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। কুরআন ও হাদিসে প্রাণীদের প্রতি সদাচরণের অসংখ্য দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা মানুষের নৈতিক উন্নতি এবং আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ দেখায়। এই অধ্যায়ে কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রাণীদের প্রতি ভালো আচরণের গুরুত্ব এবং এর শিক্ষা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
১. পশুর প্রতি দয়া করা সদকার সমান
أنَّ رَسولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ قالَ: بَيْنا رَجُلٌ يَمْشِي، فاشْتَدَّ عليه العَطَشُ، فَنَزَلَ بئْرًا، فَشَرِبَ مِنْها، ثُمَّ خَرَجَ فإذا هو بكَلْبٍ يَلْهَثُ يَأْكُلُ الثَّرَى مِنَ العَطَشِ، فقالَ: لقَدْ بَلَغَ هذا مِثْلُ الذي بَلَغَ بي، فَمَلَأَ خُفَّهُ، ثُمَّ أمْسَكَهُ بفِيهِ، ثُمَّ رَقِيَ، فَسَقَى الكَلْبَ، فَشَكَرَ اللَّهُ له، فَغَفَرَ له، قالوا: يا رَسولَ اللَّهِ، وإنَّ لنا في البَهائِمِ أجْرًا؟ قالَ: في كُلِّ كَبِدٍ رَطْبَةٍ أجْرٌ. (صحيح البخاري)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “এক ব্যক্তি পথ চলছিল, হঠাৎ তার প্রচণ্ড পিপাসা লাগল। সে একটি কূপে নেমে পানি পান করল এবং বের হওয়ার পর দেখল, একটি কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং তৃষ্ণায় মাটি চাটছে। সে বলল, ‘এটি এমন তৃষ্ণার সম্মুখীন হয়েছে যেমনটি আমি হয়েছিলাম।’ তখন সে তার জুতা পূর্ণ করে, মুখে ধরে কূপ থেকে উঠে এল এবং কুকুরটিকে পানি পান করাল। আল্লাহ তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং তার পাপ ক্ষমা করলেন।” সাহাবিরা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! পশুর প্রতি সদয় হলে কি আমাদের সওয়াব হবে?” তিনি বললেন, “প্রত্যেক জীবন্ত প্রাণীর কল্যাণে সওয়াব রয়েছে।” (বুখারী)
এ হাদীস থেকে শিক্ষা: (১) প্রাণীদের প্রতি সদয় আচরণ করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। (২) যেকোনো প্রাণীকে পানি পান করানো, খাদ্য প্রদান করা বা সুরক্ষা দেওয়া সওয়াবের কাজ, সে প্রাণী নিজের হোক বা অন্যের। (৩) পানি পান করানো ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং এটি সবচেয়ে বড় নেক কাজের অন্তর্ভুক্ত। (৪) পশু-পাখির প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অবহেলা ইসলাম গ্রহণযোগ্য মনে করে না।
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا، أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا، فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ، أَوْ إِنْسَانٌ، أَوْ بَهِيمَةٌ، إِلَّا كَانَ لَهُ بِهِ صَدَقَةٌ
(رواه البخاري، حديث رقم ٢٣٢٠)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে কোনো মুসলমান একটি গাছ লাগায় বা ফসল ফলায়, যদি কোনো পাখি, মানুষ বা কোনো প্রাণী তা খায়, তবে তার জন্য তা সদকা হিসেবে গণ্য হবে।” (বুখারী, হাদীস নং ২৩২০)
ইসলাম শুধুমাত্র মানুষের প্রতি নয়, বরং প্রাণীকুলের প্রতিও সদয় আচরণের শিক্ষা দেয়। একটি গাছ বা ফসল থেকে যদি কোনো প্রাণী উপকৃত হয়, তবে তাতেও সওয়াব পাওয়া যায়। এটি প্রমাণ করে যে, প্রাণীদের প্রতি সদয় হওয়া ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয় কাজ। পশুপাখির প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং তাদের খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করা সদকাহ্ হিসেবে গণ্য হয়। এছাড়া, প্রাণীকুলের কল্যাণে কাজ করা একটি মহৎ ইবাদত, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।
২. পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর ঘটনা
أَنَّ امْرَأَةً بَغِيًّا رَأَتْ كَلْبًا فِي يَوْمٍ حَارٍّ يُطِيفُ بِبِئْرٍ، قَدْ أَدْلَعَ لِسَانَهُ مِنَ الْعَطَشِ، فَنَزَعَتْ خُفَّهَا فَأَسْقَتْهُ، فَغُفِرَ لَهَا بِذَلِكَ
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “একজন পাপী মহিলা গরমের দিনে একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়েছিল। তার এই কাজ আল্লাহর কাছে এতটাই প্রশংসনীয় হয়েছিল যে, আল্লাহ তার সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিলেন।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৭৫২)
এই হাদিসে শেখানো হয়েছে যে, পশুদের প্রতি দয়া প্রদর্শন এমন একটি নেক আমল, যা পাপ মোচন এবং আল্লাহর রহমত লাভের কারণ হতে পারে। একজন পাপী মহিলার দয়ালু আচরণ কেবল তার আখিরাতকেই সুন্দর করে তুলেছিল না, বরং এটি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি মাধ্যমও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটি আমাদের জীবনে একটি বড় শিক্ষা দেয় যে, দয়ার কাজ ছোট হোক বা বড়, তা কখনোই আল্লাহর চোখে তুচ্ছ নয়।
৩. পশুদের কষ্ট না দেওয়ার নির্দেশ
قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَعَنَ اللَّهُ مَنِ اتَّخَذَ شَيْئًا فِيهِ الرُّوحُ غَرَضًا
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে কোনো প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে এবং তাদের কষ্ট দেয়।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৫৮)
প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শুধু মানুষের প্রতি নয়, বরং প্রাণীর প্রতিও ন্যায়বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই হাদিসের মাধ্যমে শেখানো হয়েছে যে, প্রাণীদের কষ্ট দেওয়া একটি গুরুতর পাপ, যা আখিরাতে শাস্তির কারণ হতে পারে। এটি আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে হবে, যেমন: কোনো প্রাণীকে বিনা কারণে আঘাত না করা, তাদের খাবার ও পানির চাহিদা পূরণ করা।
৪. প্রাণীকে সঠিকভাবে জবাই করার নির্দেশ
قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذِّبْحَ
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি তোমরা কোনো প্রাণীকে হত্যা করো, তাহলে তা সঠিকভাবে করো। আর যদি তোমরা জবাই করো, তাহলে সুন্দরভাবে করো।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৫৫)
প্রাণী হত্যা করার ক্ষেত্রে ইসলাম নির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে অযথা কষ্ট না দেওয়া এবং কাজটি সুন্দর ও সঠিকভাবে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি ইসলামের দয়া ও ন্যায়বিচারের একটি বড় উদাহরণ। আমাদের উচিত এই নির্দেশনা অনুসরণ করা, যাতে প্রাণীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবং তাদের কম কষ্ট হয়।
উপসংহার
কুরআন ও হাদিসে প্রাণীদের প্রতি সদয় আচরণের গুরুত্ব বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্ট প্রতিটি জীবের প্রতি আমাদের ন্যায়বিচার ও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি কেবল একটি মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং আখিরাতে সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি প্রাণীদের প্রতি ভালো আচরণ করি, তাদের অধিকার রক্ষা করি এবং দয়া প্রদর্শন করি, তাহলে এটি আমাদের নৈতিক উন্নতি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম হতে পারে।