আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা
ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসিত একটি গুণ। এটি ব্যক্তিগত জীবনে যেমন শান্তি ও সুখ আনে, তেমনি সমাজের স্থিতিশীলতা ও সুস্থতায় বড় ভূমিকা রাখে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা নিসা’র ১ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন: “আল্লাহকে ভয় কর, যিনি তোমাদের এক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন… এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সচেতন হও।” প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যে চায় তার রিযিক বৃদ্ধি পাক এবং আয়ু দীর্ঘ হোক, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।” (সহীহ বুখারী)
১. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা (সিলাতুর রহম)
مَن كانَ يُؤْمِنُ باللَّهِ واليَومِ الآخِرِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ
“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখে।” সহীহ বুখারি, হাদীস নং ৫৯৮
এই হাদিসের শিক্ষাঃ
এই হাদিসে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করার অন্যতম প্রমাণ হলো আত্মীয়দের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা। ইসলাম আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ ও সম্পর্ক রক্ষার ওপর জোর দেয়, যা একজন মুসলিমের ঈমানের অপরিহার্য অংশ।
২. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِع
“আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৫৬
এই হাদিসের শিক্ষাঃ
ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা কঠোরভাবে নিষেধ। যারা আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের জন্য জান্নাতের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা একজন মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩. আত্মীয়দের সঙ্গে ভালো আচরণ
الصَّدَقَةُ عَلَى المِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَعَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ
“একজন মিসকিনের (গরীবের) ওপর দান করা দান হিসেবে গণ্য হবে, আর আত্মীয়ের ওপর দান করলে তা দান এবং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা – উভয় হিসেবে গণ্য হবে।” সুনান তিরমিজি, হাদীস নং ৬৫৮
এই হাদিসের শিক্ষাঃ
এই হাদিসটি আমাদেরকে আত্মীয়দের প্রতি সহানুভূতি এবং সাহায্য করার গুরুত্ব শিক্ষা দেয়। একজন আত্মীয়ের প্রতি সাহায্য করা শুধু দান নয়, এর মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধনও মজবুত হয়। তাই, আত্মীয়দের প্রতি সহায়ক হওয়া দ্বিগুণ সওয়াবের কাজ।
৪. আত্মীয়দের প্রতি খারাপ আচরণ করা মহাপাপ
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
إِنَّ الرَّحِمَ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تَقُولُ: مَنْ وَصَلَنِي وَصَلَهُ اللَّهُ، وَمَنْ قَطَعَنِي قَطَعَهُ اللَّهُ
“আত্মীয়তার বন্ধন আরশে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে এবং বলে, ‘যে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন; আর যে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন।'” (সহীহ বুখারি: ৫৯৮৭; সহীহ মুসলিম: ২৫৫৫)
শিক্ষাঃ
এই হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। সম্পর্ক ছিন্ন করা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ হয়।
৫. আত্মীয়তার সম্পর্ক দীর্ঘায়ু ও বরকত আনে
مَن سَرَّهُ أَن يُبْسَطَ لَهُ في رِزْقِهِ، ويُنسَأَ لَهُ في أَثَرِهِ، فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ
“যে ব্যক্তি চায় তার রিজিক বৃদ্ধি করা হোক এবং তার জীবনের সময় বাড়ানো হোক, সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখে।” সহীহ বুখারি, হাদীস নং ৫৯৮৬
এই হাদিসের শিক্ষাঃ
এই হাদিসে বলা হয়েছে, আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করলে জীবনে বরকত আসে এবং রিজিক বৃদ্ধি পায়। ইসলাম আত্মীয়তার সম্পর্ককে এতই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে যে, এর মাধ্যমে একজন মুসলিম দুনিয়া এবং আখিরাতে উভয় ক্ষেত্রে কল্যাণ লাভ করতে পারে।
উপসংহার
উপরোক্ত হাদিসগুলোতে আত্মীয়দের সঙ্গে ভালো আচরণ এবং সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা শুধু দুনিয়ার শান্তি এবং সফলতার জন্য নয়, আখিরাতের সফলতার জন্যও অপরিহার্য। তাই আমাদের সকলের উচিত আত্মীয়দের প্রতি সদাচরণ করা, তাদের প্রয়োজনের সময় পাশে থাকা এবং সম্পর্কের বন্ধন মজবুত করা। আল্লাহ আমাদেরকে এই গুরুত্বপূর্ণ আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
আত্মীয়তার বন্ধন দুর্বল হওয়ার কারণসমূহ
১. স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা
আধুনিক সমাজে মানুষ ক্রমেই স্বার্থপর ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য আত্মীয়দের প্রয়োজনীয়তাকে অবহেলা করা হচ্ছে। কুরআনে বলা হয়েছে: “তোমরা দান করো এবং নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ফেলো না।” (সূরা বাকারা, ২:১৯৫) মানুষ যখন কেবল নিজের আর্থিক ও সামাজিক স্বার্থের পেছনে ছুটে, তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একে অপরের প্রতি দায়িত্ব ও সহানুভূতি হারিয়ে যায়।
২. প্রযুক্তির অপব্যবহার ও ভার্চুয়াল সম্পর্কের বৃদ্ধি
প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা আমাদের জীবনের একটি বড় সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছি। এতে সরাসরি সম্পর্ক বজায় রাখা দূরে সরে যাচ্ছে। প্রযুক্তি যদি সঠিকভাবে ব্যবহার না হয়, তা আত্মীয়তার সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। ইসলাম আমাদেরকে সময়ের সঠিক ব্যবহার ও ভারসাম্য বজায় রাখার উপদেশ দেয়।
৩. ভুল বোঝাবুঝি ও অহংকার
অনেক সময় আত্মীয়দের মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। এটি দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতার রূপ নিতে পারে। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “মুসলিমদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি করা হল সেই কাজ, যা দ্বীনের মূলোৎপাটন করে।” (তিরমিজি) অহংকার ও ইগোর কারণে মানুষ ক্ষমা করতে চায় না, যা সম্পর্ক ভাঙনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৪. অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও হিংসা
আত্মীয়দের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও হিংসা সম্পর্কের ভাঙনের একটি বড় কারণ। আল্লাহ বলেন:”হিংসা থেকে বেঁচে থাকো, কারণ হিংসা সমস্ত সৎকর্মকে নষ্ট করে দেয়, যেমন আগুন কাঠ পুড়িয়ে দেয়।” (আবু দাউদ) আত্মীয়দের মধ্যে হিংসা ও প্রতিযোগিতা সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি করে।
আধুনিক সমাজে আত্মীয়তার বন্ধন দুর্বল হওয়ার প্রভাব
আজকের সমাজে আত্মীয়তার সম্পর্ক ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। পরিবারগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছি। প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে আমরা ভার্চুয়াল সম্পর্ক নিয়ে বেশি সময় কাটাচ্ছি, কিন্তু আত্মীয়দের সাথে সরাসরি যোগাযোগ কমে গেছে। এর ফলে:
১. মানসিক চাপ ও একাকীত্ব
আত্মীয়দের ভালোবাসা, সমর্থন ও সহানুভূতি না পেলে মানুষ সহজেই মানসিক চাপে ভুগতে শুরু করে। আমাদের জীবনে অনেক সমস্যা ও বিপদ আসে, যেগুলো মোকাবিলার জন্য মানসিক সমর্থন প্রয়োজন। আত্মীয়রা যদি পাশে না থাকে, মানুষ তখন একাকীত্ব ও হতাশার শিকার হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক। আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক না থাকলে মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে আত্মবিশ্বাসের অভাব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়।
২. পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা
বর্তমান সমাজে বাবা-মা ও ভাই-বোনদের মধ্যে সম্পর্ক আগের মতো ঘনিষ্ঠ নয়। কর্মব্যস্ততা, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং স্বার্থপরতা বৃদ্ধির কারণে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। পরিবারের সদস্যরা একসাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছে না, যা পারিবারিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ক্ষতি করছে। ছোটখাটো মতবিরোধ ও ভুল বোঝাবুঝির কারণে পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে, যার ফলে পারিবারিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে।
৩. সামাজিক অস্থিরতা
আত্মীয়তার সম্পর্ক দুর্বল হলে সমাজে সামাজিক সহানুভূতি ও পারস্পরিক বিশ্বাস কমে যায়। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, যা সামাজিক সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর। মানুষ একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে অপরাধ, অবিচার ও অসামাজিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাওয়ায় মানুষ দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়ে, যার ফলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয় এবং অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
ইসলামের সমাধান।
ইসলাম আমাদের আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য অনুপ্রাণিত করে। একজন মুসলিমের উচিত আত্মীয়দের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, তাদের প্রয়োজনীয়তায় সহায়তা করা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা। ইসলামিক শিক্ষার মাধ্যমে আমরা শিখি, আত্মীয়তার সম্পর্ক শুধুমাত্র সামাজিক দায়িত্ব নয়, এটি একটি ইবাদতও বটে, যার জন্য আল্লাহ তাআলা বিশেষ পুরস্কার প্রদান করবেন। এই আধুনিক যুগে, আমাদের উচিত আত্মীয়তার সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা এবং ইসলামিক শিক্ষার আলোকে সমাজকে পুনর্গঠন করা। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করে আমরা আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ আরও মজবুত করতে পারি। একইসাথে, আমাদের পারিবারিক মুল্যবোধ পুনঃস্থাপন করতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এই বিষয়গুলো শেখাতে হবে। অতএব, ইসলাম আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে তা মান্য করে আত্মীয়তার সম্পর্ক মজবুত করলে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সবাই উপকৃত হবে। আমাদের উচিত এই দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে একটি শান্তিপূর্ণ, সুসংহত ও সুখী সমাজ গড়ে তোলা।