স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক: ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ দাম্পত্য জীবন
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মানব সভ্যতার ভিত্তি, এবং ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ দাম্পত্য জীবন কুরআন ও সুন্নাহর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আধুনিক সমাজে পশ্চিমা জীবনধারা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর ফলে সম্পর্কের আন্তরিকতা ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে, যা মুসলিম পরিবারগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। ইসলামে দাম্পত্য জীবন ভালোবাসা, সমঝোতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে, যেখানে সম্পর্কের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আধুনিক জীবনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করলে শান্তিপূর্ণ ও সুখী পরিবার গঠন সম্ভব, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং আধ্যাত্মিক কল্যাণ নিশ্চিত করে।
১. স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সহায়ক ও পোশাক
কুরআনের নির্দেশনা:
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
“তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরাও তাদের পোশাক।” (সূরা বাকারা: ১৮৭)
শিক্ষা:
আয়াতটিতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পোশাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেমন পোশাক আমাদের দেহকে রক্ষা ও সজ্জিত করে, তেমনি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সুরক্ষা, মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করতে সহায়ক হয়। পোশাকের মতো, স্বামী-স্ত্রীও একে অপরকে ঢেকে রাখে, সুরক্ষা দেয়, এবং দুর্বলতা গোপন রাখে। এই সম্পর্কের মাধ্যমে একজন মুসলিম স্বামী-স্ত্রীকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সংসার পরিচালনা করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
হাদিসের আলোকে:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
خَيْرُكُ
শিক্ষা:
এই হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বামীদের জন্য আদর্শ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। স্ত্রীর প্রতি সর্বোত্তম আচরণ করা একজন মুসলিম পুরুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
২. ভালোবাসা ও রহমতের সম্পর্ক
কুরআনের নির্দেশনা:
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً
“আর তার নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি লাভ করতে পারো। এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও রহমত রেখেছেন। (সূরা রূম: ২১)
শিক্ষা:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ককে ভালোবাসা ও রহমতের ভিত্তিতে গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। একজন স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক স্নেহ-মমতা এবং দয়া থাকা উচিত, যা তাদের সম্পর্ককে মজবুত ও শান্তিপূর্ণ রাখে। ভালোবাসা ও রহমত ছাড়া দাম্পত্য জীবন টেকসই ও সুখী হয় না।
হাদিসের আলোকে:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
إِنَّمَا النِّسَاءُ شَقَائِقُ الرِّجَالِ
“নারীরা পুরুষদের সহচরী।“ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ২৩৬)
শিক্ষা: এটি বোঝায় যে, নারীরা পুরুষদের সমান অংশীদার এবং তাদের প্রতি দয়া, সম্মান ও সঠিক আচরণ প্রদর্শন করা উচিত।
৩. ন্যায়বিচার ও ভালো আচরণ
কুরআনের নির্দেশনা:
وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
“তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সঙ্গতভাবে জীবনযাপন করো।“ (সূরা নিসা: ১৯)
শিক্ষা:
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পুরুষদের তাদের স্ত্রীর সাথে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে স্বামীদের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, যেমন স্ত্রীর প্রতি ন্যায়পরায়ণতা, সম্মান এবং ভালো আচরণ করা। সংসারে শান্তি ও সমঝোতা বজায় রাখতে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে জীবনযাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাদিসের আলোকে:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا، فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ
“নারীদের সাথে ভালো আচরণের ব্যাপারে তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, কারণ নারীকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।“ (সহীহ বুখারি, হাদিস নং ৩৩৩১)
শিক্ষা:
এই হাদিসে স্ত্রীর প্রতি সহিষ্ণুতা ও ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। নারীদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও স্বামীদের উচিত তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং তাদের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করা।
৪. পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতা
কুরআনের নির্দেশনা:
فَإِن كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّـهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا
“তোমরা যদি তাদের অপছন্দ করো, তবে হতে পারে যে, তোমরা কোনো বিষয় অপছন্দ করছ, অথচ আল্লাহ তাতে প্রচুর কল্যাণ রেখেছেন।“ (সূরা নিসা: ১৯)
শিক্ষা:
এই আয়াতে স্বামীদের সতর্ক করা হয়েছে যে, স্ত্রীর কোনো খুঁত বা ত্রুটি থাকলে তাতে ধৈর্য ধরতে হবে। হতে পারে আল্লাহ সেই ত্রুটিতে কোনো কল্যাণ রেখেছেন যা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায় না। তাই পারস্পরিক সম্মান, ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে সম্পর্ককে শক্তিশালী করে তোলা উচিত।
হাদিসের আলোকে:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
“স্ত্রীর প্রতি তোমাদের দায়িত্ব হলো তাদের ভরণ-পোষণ এবং সঙ্গতভাবে তাদের পোশাকের ব্যবস্থা করা।“ (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ১২১৮)
শিক্ষা:
এই হাদিসে স্বামীর দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্ত্রীদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ, যেমন খাদ্য ও পোশাকের ব্যবস্থা করা স্বামীর ওপর আবশ্যক।
৫. পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব
কুরআনের নির্দেশনা:
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ
“তাদের (স্ত্রীদের) জন্য অধিকার রয়েছে যেমন অধিকার তাদের (স্বামীদের) ওপর রয়েছে সঙ্গতভাবে।“ (সূরা বাকারা: ২২৮)
শিক্ষা:
আয়াতটিতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমতা ও ভারসাম্য বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। উভয়ের জন্য অধিকার ও দায়িত্ব সমানভাবে বণ্টন করা হয়েছে, এবং উভয়ের উচিত একে অপরের অধিকার রক্ষা করা। এটি ইসলামে দাম্পত্য জীবনের মূল নীতি।
হাদিসের আলোকে:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
مَا أَنفَقْتَ عَلَى نَفْسِكَ فَهُوَ لَكَ صَدَقَةٌ، وَمَا أَنفَقْتَ عَلَى أَهْلِكَ فَهُوَ لَكَ صَدَقَةٌ
“তুমি নিজের জন্য যা ব্যয় করো, তা তোমার জন্য সদকা। আর তুমি তোমার পরিবারের জন্য যা ব্যয় করো, সেটাও তোমার জন্য সদকা।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৯৯৩)
শিক্ষা: এই হাদিসে পরিবারে ব্যয় করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। স্বামীদের জন্য পরিবারের জন্য খরচ করাও একটি ইবাদত ও পুরস্কারের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপসংহার
কুরআন ও হাদিসে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে যে দায়িত্ব, ভালোবাসা ও সম্মানের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, তা দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক সুখ ও শান্তি নিশ্চিত করার মূল চাবিকাঠি। ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্বও বহন করে। পারস্পরিক সম্মান, ভালো আচরণ, দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব।